পুষ্টিগুণে ভরপুর পালংশাকের উপকারিতা জানুন

পালংশাকের পরিচিতিঃ
পালং শাক আমাদের সবার কমবেশি প্রিয়। বারমাস কাল পাওয়া যায় এই শাক। তবে শীতকালে বেশি পাওয়া যায় এই শাক। অনেক এলাকাতে এই শাক রান্না করা ঝোল অনেকে স্যুপের মতো করে খায় যা শরীরের জন্য অনেক পুষ্টিকর।পালং শাক ভাজি হিসেবে খাওয়া যায়, তবে এই শাক রান্না করে মাছের সঙ্গে খাওয়া খুবই সুস্বাদু। এই শাকে আছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’। এজন্য পালং শাক খেলে শরীর যেমন সুস্থ থাকে, এমনকি শরীরের রোগ-ব্যাধি সারাতেও এই পালং শাকের রয়েছে অনেক ভূমিকা।

এই শাক আমাদের শরীরের অন্ত্র সচল রাখতে অনেক বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। আমাদের শরীরের অন্ত্রের ভেতরে জমে থাকা মল খুব সহজে বের করে দেয়। সাধারনত ডায়াবেটিস রোগীরা এই শাক পরিমাণমতো খেলে উপকার পান। পালং শাকের বীজও খুব উপকারী শরীরের জন্য। পালং শাকের বীজের ঘন তেল কৃমি ও মূত্রের রোগ সারাতে সাহায্য করে। তাছাড়া পালং শাকের কঁচি পাতা আমাদের শরীরের ফুসফুস, কণ্ঠনালীর সমস্যা, এমনকি শরীর জ্বালাপোড়া ইত্যাদি সমস্যা দূর করতেও অনেক বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। পালং শাকের একটা বড় গুণ হল এটা শরীর ঠান্ডা রাখে। আমরা অনেকেই জন্ডিসে ভুগে থাকি,তাই জন্ডিসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য পালংশাক বিশেষ উপকারী। পালংশাককে বলা হয় রক্ত পরিষ্কারক খাদ্য বা সবজি।এটা এমনকি শরীরের রক্ত বৃদ্ধিও করে থাকে। আরও কিছু সুবিধা আছে এই পালং শাকে যেমন এটা চোখের জ্যোতি বাড়ায় এবং আমাদের মুখের লাবন্য অনেকাংশে বৃদ্ধি করে থাকে। তাই আমাদের স্বাস্থ্যরক্ষায় পালং শাকের কিছু উপকারিতা সম্পর্কে আজ আপনাদের জানাবো।

পুষ্টিগুণে ভরপুর এই পালংশাক-
আমরা সাধারণত শাক সবজি বলতেই পুষ্টিগুণে ভরপুর সেটা আমাদের সবারই জানা। পালং শাকও এর ব্যতিক্রম নয়। পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ক্যারোটিন, এমিনো এসিড, ভিটামিন এ, সি, কে, এবং বি কমপ্লেক্স, কী নেই এই পালংশাকে? বিভিন্ন প্রকার পুষ্টি গুণে ভরপুর এই শাকটি যেমন আমাদের শরীরের বিভিন্ন সমস্যা দূর করে আমাদের শরীরকে ফিট রাখতে সাহায্য করে ঠিক তেমনভাবেই রূপচর্চায়ও এর জুড়ি নেই। আমরা রুপচর্চার জন্য ব্যবহার করি এমন বাজারের অনেক ক্ষতিকর প্রোডাক্ট পাওয়া যায়, এই ক্ষতিকর কেমিকেলের প্রোডাক্ট ব্যবহারের চাইতে প্রাকৃতিক জিনিস ব্যবহারের কোন বিকল্প নেই। আর তা যদি হয় প্রয়োজনীয় সব ভিটামিনে সমৃদ্ধ এমন কিছু একটি সবজি তাহলে তো কথাই নেই বললেই চলে।

এক কাপ পালং শাক খাদ্য আঁশের দৈনিক চাহিদার ২০% পূরণ করার সাথে সাথে ভিটামিন এ ও কে-এর দৈনিক চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম। এতে উচ্চ মাত্রার প্রোটিন, ভিটামিন সি, ভিটামিন ই, আয়রন, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, জিংক, ফলিক এসিড ও সেলেনিয়াম রয়েছে। এই সমস্ত পুষ্টি উপাদানগুলো শরীরের স্বাভাবিক কাজকর্ম এর জন্য অপরিহার্য।

পালংশাকের পুষ্টির তালিকাঃ
প্রতি ১০০ গ্রাম পালং শাকে প্রোটিন আছে ২.০ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ৭৩ মি. গ্রাম, আয়রন ১১.২ মি. গ্রাম, কার্বোহাইড্রেট আছে ২.৮ গ্রাম, অাঁশ আছে ০.৭ গ্রাম, অক্সালিক অ্যাসিড থাকে ৬৫২ মি. গ্রাম, ফসফরাস আছে ২০.৩ মি. গ্রাম, অ্যাসিড (নিকোটিনিক) ০.৫ মি. গ্রাম, রিবোফ্লোবিন থাকে .০৮ মি. গ্রাম, ক্যালসিয়াম ৭৩ মি. গ্রাম, পটাশিয়াম ২০৮ মি. গ্রা, ভিটামিন-এ আছে ৯৩০০ আই. ইউ, ভিটামিন সি ২৭ মি. গ্রা, থায়ামিন আছে .০৩ মি. গ্রা। আমাদের গ্রামাঞ্চলে অতীতে বাজারে টক পালংও কিনতে পাওয়া যেত। কিন্তু এখন তা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে বললেই চলে। এই টক পালংশাকও ছিল খুবই উপকারী। সব থেকে বড় কথা হল শিশুদের জন্য এই পালং শাক বিশেষ উপকারী।

পালংশাক শক্তির মাত্রা বৃদ্ধি করে থাকে-
পালংশাক আমাদের শরীরের ক্লান্তিভাব দূর করে শক্তির মাত্রা বৃদ্ধি করে দেয়।পালংশাক রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আয়রন যা আমাদের দেহে অক্সিজেন উৎপাদনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া এতে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান লিম্ফোবিক এসিড যা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যেমন ভিটামিন সি ও ই কে পুনরুজ্জীবিত করতে অনেক বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। পালংশাক আমাদের রক্তের সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং দিনের বেলার ক্লান্তিভাব দূর করে।

পুষ্টিগুণে ভরপুর পালংশাকের উপকারিতা জানুন

রূপচর্চায় ব্যবহার করুন পালংশাক
ত্বক আমাদের সবকিছুর পরিচয় বহন করে। আমরা আমাদের ত্বক থেকে বয়সের ছাপ লুকানোর জন্য কতকিছুই না করি। বাজারের সব দামি দামি ক্রিম আমরা ব্যবহার করে থাকি, আবার শাকসবজির ট্রিটমেন্টও নিচ্ছে অনেকেই। অথচ শাকসবজির রাজা প্রাকৃতিক ট্রিটমেন্ট পালং শাকেই আছে এন্টিঅক্সিডেন্ট, যার প্রধান কাজ হলো কোষে অক্সিডেন্ট যোগানো। অক্সিডেন্ট আমাদের ত্বকের ক্ষয় রোধ করে এবং ত্বক সুস্থ শবল রাখে।অর্থাৎ বার্ধক্যকে জয় করতে পালং-শাকের ভূমিকা অনেক।

ত্বক ও চুলের যত্নে যখন পালংশাক:
১.ব্রণের সমস্যাই সম্মুখীন হন নাই এমন মানুষ হইত খুঁজে পাওয়া খুব কষ্টকর। পালংশাক ব্রণের সমস্যা দূর করে স্বাস্থ্যজ্জ্বল ত্বক পেতে কার্যকরী ভুমিকা পালন করে। সেক্ষেত্রে পালং শাক দিয়ে ফেইস মাস্ক তৈরি করে ব্যবহার করতে পারেন। পরিমাণ মতো পালং শাক এবং পানি নিয়ে ব্লেন্ডারে ভালো মতো ব্লেন্ড করে নিন যেন মিশ্রণটি পেস্টের মতো হয়। এটি মুখে সমান ভাবে লাগিয়ে ২০ মিনিট রাখুন। এরপর মুখ ধুয়ে ফেলুন। এই ফেইস মাস্কটি ত্বকের রোমকুপে জমে থাকা ময়লা ভিতর থেকে পরিষ্কার করে ত্বক উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত করে তোলে।

২. আপনি সুন্দর, মসৃণ ত্বক পেতে চাইলে পালং শাক এবং অন্যান্য সবজি মিশিয়ে ভেজিটেবল জুস বানিয়ে খেতে পারেন। এ ক্ষেত্রে আপনি করতে পারেন অর্ধেক টমেটো, ১/৪ শশা, একটি গাজর, আধা কাপ বাঁধাকপি এবং এক কাপ পালং শাক এবং পরিমানমত পানি দিয়ে ভালো মতো ব্লেন্ড করে জুস তৈরি করুন। আপনি যদি প্রতিদিন এক গ্লাস করে এই ভেজিটেবল জুস পান করতে পারেন তাহলে আপনি এর পরিবর্তনটা নিজের চোখেই দেখতে পাবেন। পালংশাকের এই জুসটি আপনার মুখের ব্রণ এবং ব্রণের দাগ দূর করে ত্বক ভিতর থেকে উজ্জ্বল করে তুলতে খুব উপকারী ভূমিকা পালন করে থাকে।

৩. আপনি যদি নিয়মিত পালং শাক খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেন তাহলে সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে রক্ষা করতে পারেন নিজের ত্বক। আমরা অনেকেই জানিনা যে পালংশাকে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি যা সূর্যের ক্ষতিকারক আলট্রা ভায়োলেট রশ্মি থেকে আপনার ত্বককে রক্ষা করে। যার ফলে স্কিন ক্যান্সার হওয়া থেকে আপনাকে রক্ষা করবে।

৪. আমাদের শরীরে এক ধরনের “ফ্রি র‌্যাডিকেলস” রয়েছে যা ত্বককে ড্যামেজ করে এতে বার্ধক্যের ছাপ ফুটিয়ে তোলে। তবে আপনি যদি খাবারের তালিকায় পালং শাক রাখেন তাহলে এর মাধ্যমে এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারেন সহজেই। তাই আপনি নিয়মিত পালং শাক খান এবং ত্বকের বার্ধক্যজনিত সমস্যা থেকে দূরে থাকুন।

৫. ৪-৫ টি পালং শাক প্রথমে পেস্ট করে এর সাথে ১ চা চামচ মধু এবং ২ চা চামচ লেবুর রস ভালো মত মিশিয়ে নিন। এই মিশ্রণটি মুখে লাগিয়ে ২০ মিনিট রাখুন। এরপর মুখ ধুয়ে ফেলুন। এই মাস্কটি ত্বকের নিস্তেজ ভাব দূর করে ত্বক নরম এবং মসৃণ করে তোলে।

৬. পালং শাক আমাদের চুলের বৃদ্ধি ত্বরাণ্বিত করতে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। কারণ পালংশাকে রয়েছে ভিটামিন বি, সি এবং ই, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড। এই গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলো সবই চুলের বৃদ্ধিতে কার্যকরী ভুমিকা পালন করে থাকে।

স্বাস্থ্যরক্ষায় পালংশাকের ভূমিকাঃ
১. যেহেতু পালংশাক ফাইবারে সমৃদ্ধ তাই এটি নিয়মিত খাওয়ার মাধ্যমে আমাদের পাকস্থলির বিভিন্ন সমস্যা যেমন কোষ্ঠকাঠিন্য, বদ হজম সহ বিভিন্ন সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

২.বিশেষ করে গর্ভবতী মহিলাদের জন্য পালং শাক অত্যন্ত উপকারী একটা খাদ্য। মায়ের গর্ভে থাকা শিশুর ঠিক মতো বেড়ে উঠার জন্য এই পালংশাক প্রয়োজনীয় নিউট্রিয়েন্টস যোগান দিয়ে থাকে। এছাড়াও নিয়মিত পালং শাক খাওয়ার মাধ্যমে মায়ের বুকের দুধের পরিমাণ এবং গুণমান অনেকাংশে বেড়ে যায়।

৩. পালংশাকে থাকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ এবং ক্যারিটনয়েডস দৃষ্টিশক্তিজনিত সমস্যা থেকে রক্ষা করবে আপনাকে।

৪. আপনি যদি নিয়মিত পালং শাক খান এতে করে আপনার হাই ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণ থাকবে। কারন পালংশাক হাই ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে রাখতে বেশ কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকে।

৫. আমাদের শরীরে এনিমিয়া বা রক্তশুন্যতা প্রতিরোধে পালংশাক বেশ কার্যকরী ভুমিকা পালন করে। পালংশাকে থাকা প্রয়োজনীয় ভিটামিনস এবং নিউট্রিয়েন্টস শরীরের রক্তে লোহিত রক্ত কণিকা উৎপন্ন করতে সাহায্য করে যার ফলে রক্তশুন্যতায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায় অনেকখানি।